অর্থনীতি কী | অর্থনীতি ইংরেজি কি | অর্থনীতির প্রকারভেদ এবং সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

by | Apr 29, 2023 | Others

অর্থনীতি একটি পরিবর্তনশীল সমাজবিজ্ঞান, যা মানুষের অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের মাঝে সমন্বয় সাধন করে থাকে। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ “Economics” (ইকোনোমিক্স)। শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ “ওইকোনোমিয়া” থেকে, যার অর্থ গৃহ পরিচালনা। 

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টোটলের মতে, গৃহ পরিচালনা করার বিজ্ঞান হলো অর্থনীতি। তবে সময়ের ব্যবধানে অ্যারিস্টটলের গৃহ পরিচালনা করার বিজ্ঞানের মধ্যে অর্থনীতি সীমাবদ্ধ থাকে নি। বর্তমানে ব্যপক বিস্তৃতি লাভ করেছে।

বলতে পারেন অর্থনীতি বা অর্থশাস্ত্র সামাজিক বিজ্ঞানের এমন একটি শাখা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা পণ্য এবং সেবার উৎপাদন, সরবরাহ, বিনিময়, বিতরণ  ভোগ ও ভোক্তার আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। আমাদের আজকের এই লেখার মাধ্যমে আমরা অর্থনীতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।

অর্থনীতি ইংরেজি কি

আরও পড়ুনঃ প্রকল্প কাকে বলে | প্রকল্প কি | প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য, ধরন ও জীবনচক্র

অর্থনীতি কী, প্রকারভেদ ও পরিধি

“সম্পদ সীমিত কিন্তু চাহিদা অফুরন্ত” – এই মৌলিক পরিপ্রেক্ষিতে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা অর্থনীতির প্রধান উদ্দেশ্য।  এ পর্যন্ত বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এর সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন যা পরবর্তীতে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়েছে। সেগুলো হলো:

১. সম্পদের বিজ্ঞান

২. কল্যাণের বিজ্ঞান

৩. প্রাচুর্যের বিজ্ঞান

এখানে সম্পদের বিজ্ঞান হিসেবে যারা অর্থনীতিকে অভিহিত করেছেন তারা হলেন, 

  • অ্যাডাম স্মিথ
  • ডেভিড রিকার্ডো
  • জন স্টুয়ার্ট মিল সহ প্রমুখ।

যাদেরকে বলা হয় ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ। এনারা সবাই ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকের। 

অপরদিকে অর্থনীতিকে কল্যাণের বিজ্ঞান বলে যারা মতামত প্রদান করেছেন তারা হলেন

  • আলফ্রেড মার্শাল
  • ফিশার
  • পিগু
  • অ্যারো
  • ডেভেনপোর্ট
  • ক্যানন সহ প্রভৃতি।

সেইসাথে অর্থনীতিকে কল্যাণের বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করেছেন

  • লিয়নেল রবিন্স।

যাকে বলা হয় নিও ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবীদ। 

আরও পড়ুনঃ মূলধন বাজেটিং কাকে বলে

তবে এল রবিন্স এর প্রদত্ত সংজ্ঞাটির বেশিরভাগ আধুনিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে জানা যায়। কারণ, তার মতে “অর্থনীতি মানুষের অসীম অভাব ও বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের সম্পর্ক বিষয়ক মানব আচরণ নিয়ে আলোচনা করে” । 

আর তার এই বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এটি মানব জীবনের তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। যথাঃ

  • অসীম অভাব
  • সীমিত সম্পদ ও
  • বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সম্পদ।

তাই, সবকিছু বিবেচনা করে অর্থনীতির পরিধি সমূহ কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যেমনঃ

  • ব্যষ্টিক অর্থনীতি ও সামষ্টিক অর্থনীতি
  • নেতিবাচক অর্থনীতি ও ইতিবাচক অর্থনীতি
  • মেইনস্ট্রিম ও হেটারোডক্স অর্থনীতি।

অপরদিকে এই অর্থনীতিকে আধুনিকতার দিক বিবেচনা করে দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-

নাম্বার ১- ব্যষ্টিক অর্থনীতি

নাম্বার ২- সামষ্টিক অর্থনীতি। 

অর্থনীতির সংজ্ঞা সবচাইতে সহজ সাবলীল ভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তিনজন ব্যক্তি। তারা হলেন অ্যাডাম স্মিথ, মার্শাল এবং লিয়নেল রবিনস।

অ্যাডাম স্মিথের মতে, “অর্থনীতি হচ্ছে এমন একটি বিজ্ঞান, যা জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি এবং তার কারণ অনুসন্ধান করে”।

তিনি তার এই মতামত প্রকাশ করেছেন এবং অর্থনীতির মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা প্রদান করেছেন ১৭৭৬ সালে নিজস্ব লিখিত একটি গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে যেটার নাম ‘An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations’।

অপরদিকে মার্শালের মতে, “অর্থনীতি মানুষের জীবনের দৈনন্দিন সাধারণ কার্যাবলী আলোচনা করে”। অর্থাৎ তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মানুষের সাধারণ কার্যাবলী বলতে বোঝানো হয়েছে, মানুষ কিভাবে অর্থ উপার্জন করে ও কিভাবে সেই উপার্জিত অর্থ তার বিভিন্ন অভাব মেটানোর জন্য ব্যয় করে। তিনি তার এই মতামত প্রকাশ করেছেন ১৮৯২ সালে প্রকাশিত ’Economics of Industry’ নামক গ্রন্থটি প্রকাশের মাধ্যমে। 

অপরদিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা সামাজিক বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবিনস অর্থনীতির সংজ্ঞা প্রদান করেছেন “Nature and Significance of Economic Science” নামক তার লিখিত গ্রন্থের মাধ্যমে। তার মতে, “অর্থনীতি মানুষের অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সম্পদের সম্পর্ক বিষয়ক আচরণ সম্বন্ধে আলোচনা করে”। 

আরও পড়ুনঃ বিশেষায়িত ব্যাংক কাকে বলে | বিশেষায়িত ব্যাংক কয়টি ও কি কি?

অর্থনীতির ইতিহাস

লেনদেন, চাহিদার যোগান, বিনিময়, ভোগ ইত্যাদি অর্থনৈতিক পরিভাষার প্রয়োগ-প্রচলন পৃথিবীর প্রতিটি সমাজেই খুব স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান। তাই, অর্থনীতির এই পরিভাষা, হিসাব-নিকাশের প্রয়োগ পৃথিবীর প্রথম মানুষের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও তার উদ্ভব ঘটেছিল মাত্র ২৫০ বছর আগে। 

জানা যায়, উনিশ শতকের শেষের দিকে আলফ্রেড মার্শাল রাজনৈতিক অর্থনীতি থেকে অর্থনীতির বিজ্ঞান এর সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে “অর্থনীতি” নামকরণ করেন। সে সময়ে এটা শৃংখলাবদ্ধ চিন্তা ভাবনার জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং গণিতের ব্যবহার ব্যপক হারে বাড়তে থাকে, যা পরবর্তীতে এটাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বাইরে বিজ্ঞানের আলাদা একটি শাখা হিসেবে গ্রহনযোগ্যতা অর্জনে সহায়তা প্রদান করে। 

অর্থনীতির ইতিহাস দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস। তবে এর যাত্রা শুরু হয় অ্যাডাম স্মিথ কর্তৃক গৃহীত গ্রন্থ “An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations” এর মাধ্যমে। কারণ, এই গ্রন্থে অ্যাডাম স্মিথ অর্থনীতিকে সম্পদের বিজ্ঞান হিসেবে সহজ ও সাবলীল ভাষায় আখ্যায়িত করেছিলেন। তার সংজ্ঞার মূল বিষয়বস্তু ছিল সম্পদ উৎপাদন ও ভোগ। মূলত অর্থনীতির সাথে উন্নয়ন সরাসরি সম্পর্কিত। তাইতো নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবীদ অমর্ত্য সেন বলেছেন,  জনসাধারণের সক্ষমতার নামই উন্নয়ন”।  

তবে এডাম স্মিথের প্রকাশিত গ্রন্থের পরবর্তীতে আধুনিক অর্থনীতির যাত্রা সুদৃঢ় হলেও, এর অনেক পূর্বে ইউরোপে আরও বেশকিছু অর্থনৈতিক কালের আবির্ভাব ঘটেছিল বলে জানা যায়। কারণ, মধ্যযুগ, সামন্তবাদের পতন, জাতীয়তাবাদের উত্থান, দার্শনিক, ধার্মিক নেতাদের রাষ্ট্র সিংহাসনে আসীন, স্বাধীনচেতা মনোভাবে পুষ্ট জাতি ও গোষ্ঠীগুলো যখন পরস্পর পরস্পরকে যোগ্য শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে তখন ইউরোপীয় নবজাগরণের অগ্রদূত নিকোলা ম্যাকিয়াভ্যালির শাসক হয়ে ওঠার উৎসাহ তৎকালীন ইউরোপীয়দের মনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের আশার জন্ম দিয়েছিল।

জানা যায়, ষোল শতকের প্রথমদিকে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল। আর সেসময় অর্থকে মানুষ এতোটাই সমীহ করতে শুরু করেছিল যে, তারা ভাবতো “অর্থ অধিক যার, রণক্ষেত্রের বিজয়ও তার”।  তাই, অর্থলোভী স্বাধীনচেতা ইউরোপীয়রা সেসময় অর্থের সন্ধানের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, যারফলে তাদেরকে ব্যবসায়ী বা মার্কেনটাইলিস্ট হিসেবে অভিহিত করা হয়। 

মাত্র তিনশো বছর আগে ইউরোপের মার্কেন্টাইলিজম শক্তিধর একটি তত্ত্ব হয়ে ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। জানলে অবাক হবেন, , ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি বেশকিছু দেশের পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক অগ্রযাত্রার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল মার্কেন্টাইলিজম।

তাদের অগ্রযাত্রার জন্যই ক্রমেক্রমে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিস্তার লাভ করে। আর বাজারে অন্যান্য অর্থনীতির ব্যপক বিস্তার ঘটতে থাকে। শুধু তাই নয়, জনগণ রিয়েল এস্টেট, কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি তৈরীর কাজে অধিক ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু পরবর্তীতে মার্কেন্টাইলিজম এর বাজে কিছু নিয়ম নীতির কারণে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে এর বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু তবুও তাদের শিল্প বাণিজ্য পরবর্তী সময়ে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল বলে জানা যায়। 

প্রারম্ভিক ঐতিহাসিক চিন্তাধারা

প্রাচীন অর্থনীতিতে চিন্তাধারা মেসোপটেমিয়া, গ্রিক, রোমান, ভারতীয়, চৈনিক, পারস্য এবং আরব সভ্যতা সমসাময়িক। আর অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনার প্রাচীন লেখক বৃন্দের মধ্যে রয়েছেন অ্যারিস্টটল, চানক্য, কিন সি হুয়াং, টমাস একুইনাস, ইবনে খালদুন প্রমুখ। 

মূলত সময়ের বিবর্তনে পরবর্তীতে ১৮ শতকের দিকে একদল চিন্তাবিদ ও লেখক আয় এবং উৎপাদনের চক্রাকার প্রবাহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক চিন্তাধারার উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হন। অবশ্য যদিও অ্যাডাম স্মিথ সেই সকল চিন্তাবিদ ও লেখকদের প্রক্রিয়াগুলোকে সম্পূর্ণভাবে ভুল বলে ব্যাখ্যা করেন, তবুও এখন পর্যন্ত সেগুলো অর্থনীতিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাদের মতে একমাত্র কৃষি উৎপাদনই খরচের বেশি মুনাফা বয়ে আনতে পারে। সুতরাং, কৃষির ওপর সম্পদের বিষয়টি নির্ভরশীল।

আশা করি, আপনারা আজকের এই লেখাটির মাধ্যমে খুব সংক্ষেপে অর্থনীতির ইতিহাস ও প্রকারভেদ সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।

Google News

ABOUT THE AUTHOR

Mitu Khatun

Hi, I am Mitu. I love to travel to the most beautiful natural places in this world.